দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় ভারতীয় পণ্য বয়কট আন্দোলন। কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে ‘ইন্ডিয়া আউট’ স্লোগানও দিচ্ছেন। এ নিয়ে সরব হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিও। দলটির অনেক নেতাই এখন ভারতবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি দেশটির পণ্য বর্জনে ক্যাম্পেইন করছেন। তাদের আভিযোগ, ভারতের প্রভাবেই দেশে এখন গণতন্ত্রহীনতা। তাই আসন্ন ঈদুল ফিতরের পর ভারতবিরোধী আন্দোলন আরও জোরদার করার কথা ভাবা হচ্ছে।
তবে দলটির দায়িত্বশীল নেতাদের ভাষ্য, ভারতবিরোধী আন্দোলন নিয়ে দলে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সার্বিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কমপক্ষে দুই বছর আগে থেকে ভারত বিরোধিতা থেকে সরে আসে। কাজ শুরু করে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে। তখন বিএনপি নেতাদের যুক্তি ছিল, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারত অনেকটাই প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিল। দেশটি তখন জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আসতে বাধ্য করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি আন্দোলন গড়ে তুললেও দলটি তাতে হালে পানি পায়নি। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনী বৈতরণী পার করার ক্ষেত্রেও দেশটি ক্ষমতাসীনদের নীরব সমর্থন দিয়েছিল। সে জায়গা থেকে বিএনপি নেতাদের উপলব্ধি ছিল, ভারত অন্তত তাদের সহযোগিতা না করলেও যেন সরাসরি বিপক্ষে না যায়। সেজন্য ২০২৪ এর নির্বাচনের আগে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ায় বিএনপি।
নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যখন শক্ত অবস্থানে, তখন ভারত ‘তলে তলে’ আওয়ামী লীগের পক্ষেই অবস্থান নেয়। বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হওয়ার পর নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকে বিএনপি প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী অবস্থান নেয়।
দলটির সূত্র বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভারতের সমর্থন পেতে বিএনপি তার দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীকেও একমঞ্চে ওঠায়নি। তারপরও নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যখন শক্ত অবস্থানে, তখন ভারত ‘তলে তলে’আওয়ামী লীগের পক্ষেই অবস্থান নেয়। বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হওয়ার পর নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকে বিএনপি প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী অবস্থান নেয়।
এ দফায় সরকার গঠনের পর কয়েকজন মন্ত্রী বলেছেন, ভারতের সমর্থনের কারণেই অন্য কোনো দেশ নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এরপর নিজেদের ভারতবিরোধী অবস্থান আরও শক্ত করেছে বিএনপি।
গত ২০ মার্চ রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপি ও দলটির অঙ্গ সংগঠনের নেতারা ভারতের পণ্য বর্জন করে একটি বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। সেখানে যোগ দেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি নিজের সঙ্গে আনা একটি ভারতীয় চাদর ছুড়ে ফেলে ওই বিক্ষোভে সংহতি প্রকাশ করেন। একই দিন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিএনপিসহ ৬৩ রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জন কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করেন রিজভী। এরপর থেকে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতবিরোধী মনোভাব আরও তুঙ্গে ওঠে।
যদিও এর আগে থেকেই দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রায়ই ভারতবিরোধী বক্তব্য দিয়ে আসছেন। ভারতীয় পণ্য শুধু বর্জনই নয়, এখন জনগণকে ভারতে না যাওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। এছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা দলগুলোও ভারতের পণ্য বর্জন ক্যাম্পেইন করে আসছে।
হঠাৎ করেই বিএনপির দলীয়ভাবে ভারতবিরোধী ক্যাম্পেইন নিয়ে রাজনীতির মাঠে এখন নানান আলোচনা চলছে।
দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে রুহুল কবির রিজভী যাই করেন, সেখানে হাইকমান্ডের সমর্থন রয়েছে। এর বাইরে তিনি কোনো কর্মসূচি পালন করবেন এটা কারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। পরিস্থিতি পর্যালোচনা চলছে। ঈদের পরে ভারতবিরোধী কর্মসূচি আরও প্রবল হতে পারে।
বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি নেতাদের, যারা যারা ভারতীয় পণ্য বর্জন করবেন, সবাই বাড়িতে গিয়ে তাদের বউরা যেন কোনোমতে কোনো ভারতীয় শাড়ি না পরেন। তাদের আলমারিতে যে কয়টা শাড়ি আছে, সব এনে যেদিন ওই অফিসের সামনে পোড়াবে, সেই দিন বিশ্বাস করবো যে, আপনারা সত্যিকার ভারতীয় পণ্য বর্জন করলেন।
প্রধানমন্ত্রী এই বক্তব্যের জবাবে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের বউয়েরা খুব একটা ভারতীয় শাড়ি পরে না। বিএনপি অন্যের দ্বারস্থ হবে না। নিজেরাই স্বাবলম্বী হবে।
সূত্র জানায়, এ নিয়ে ২৬ মার্চ বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়। সেখানে ভারতীয় পণ্য বর্জন কর্মসূচিতে রুহুল কবির রিজভীর সংহতি নিয়ে বৈঠকে তিনজন নেতা প্রশ্ন তোলেন। দলীয় সিদ্ধান্ত ছাড়া দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে রিজভী কীভাবে সংহতি জানান? বিষয়টি রিজভীর ব্যক্তিগত কর্মসূচি বলে দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে ওই তিন নেতাকে জবাব দেওয়া হয়। এছাড়া বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি।
বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। দল হিসেবে তার করণীয় নির্ধারণ হবে। আর এখন সাধারণ মানুষের ক্ষোভ থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।-আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী
তবে আরেকটি সূত্রের দাবি, দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে রুহুল কবির রিজভী যাই করেন, সেখানে হাইকমান্ডের সমর্থন রয়েছে। এর বাইরে তিনি কোনো কর্মসূচি পালন করবেন এটা কারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়। পরিস্থিতি পর্যালোচনা চলছে। ঈদের পরে ভারতবিরোধী কর্মসূচি আরও প্রবল হতে পারে।
বিএনপির ভারতবিরোধী রাজনীতি প্রসঙ্গে রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপির ভারত বিরোধিতার থেকে বড় কথা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ নেতাদের কথায় স্পষ্ট, ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। স্বাধীন দেশে কোনো দেশপ্রেমিক এটি মেনে নিতে পারে না।
বিএনপির আরেক নেতা ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন। দলে প্রভাবশালী তরুণ এ নেতা প্রায় প্রতিদিনই নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ভারতবিরোধী স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছেন।
এরই মধ্যে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে যুক্তরাজ্য বিএনপির আলোচনা সভা ও ইফতার মাহফিলে বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে তিনি বলেন, এই স্বাধীনতা দিবসে প্রতিবেশী দেশ আমাদের লাশ উপহার দিয়েছে। দেশের তরুণরা চাকরি না পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ যাচ্ছে। অথচ প্রতিবেশী দেশের মানুষ বাংলাদেশে চাকরি করছে।
এ বক্তব্যে তারেক রহমান ভারতের নাম না নিলেও তিনি যে ভারতকেই বোঝাতে চেয়েছেন, সেটি স্পষ্ট।
ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বানে দল হিসেবে বিএনপি যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটা, জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। দল হিসেবে তার করণীয় নির্ধারণ হবে। এখন সাধারণ মানুষের ক্ষোভ থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় জাগো নিউজকে বলেন, রাজনৈতিক দলের উচিত মানুষের চাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া। এটি দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলাপের পর জানাতে পারবো।