এটি কোন রূপকথা বা সিনেমার গল্প নয়, ইতিহাসের এক বাস্তব প্রতিফলন। অযত্নে অবহেলায় পরে আছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় তীর্থস্থান বরিশালের কানাই বলাই দিঘী। আর এই দৃশ্য বাস্তব জানতে ও দেখতে হলে যেতে হবে বরিশালের পটুয়াখালী জেলা বাউফল উপজেলার ১ নং কাছিপাড়া ইউনিয়নে।
ধারণা করা হয়, আনুমানিক ১০০ বছরেরও বেশি সময় পূর্বে এই এলাকার লোকজনের বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করার জন্য এই দিঘীটি খনন করা হয়। সেই থেকে দিঘীটি এলাকার লোকজনের বিশুদ্ধ পানীয় জলের যোগান দিয়ে আসছিল। তখনও এ দিঘীটির কোন নির্দিষ্ট নাম ছিল না।
লোকমুখে প্রচলিত, শতাধিক বছর পূর্বে কাছিপাড়া গ্রামের দিঘীর পাশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কানাই-বলাই নামে দুই ভাই থাকতো। দুই ভাই প্রতিদিন ভোর রাতে উঠে নিজ গ্রামের সকল হিন্দু বাড়িতে বাড়িতে নাম কীর্তন করতো। একদিন সকাল বেলা দুই ভাই স্নান করছিল।
গোছলের সময়ে তারা খেজুর গাছের ওপরে বসেছিল। কিন্তু তারা যেটিকে খেজুর গাছ মনে করেছিল, সেটি মূলত বৃহৎ আকৃতির এক গজাল মাছ ছিল। শরীরে সাবান দেয়ার সময় মাছটি দুই ভাইকে নিয়ে জলের গভীরে চলে যায়। এরপর আর কোনোদিন দুই ভাইয়ের দেখা মেলেনি।
তারপর থেকেই এ দিঘীটি কানাই-বলাই দিঘী নামে পরিচিতি লাভ করেছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এই কানাই-বলাই দিঘীকে তাদের একটি তীর্থস্থান মনে করেন। অথচ সংস্কার ও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে অস্তিত্ব বিলীনের পথে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই তীর্থস্থান কানাই-বলাই দিঘী।
হিন্দু ধর্মাবলম্বী দর্শনার্থী কাজল রাণী দাস বলেন, “আমরা হিন্দুরা মনে করি এই কানাই-বলাই দিঘী আমাদের কাছে একটি তীর্থস্থান। আমি প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে এখানে আসি পূজা-অর্চনা করতে এবং দিঘীর জলে দুধ-কলা দিতে ও স্নান করতে।”
রাণী দাসের মতে এখানে কোন আশা পূরণের উদ্দ্যেশ্যে মানত করলে তা পূর্ণ হয়। “অনেকবার আমি এ দীঘিতে মানত করে ফল পেয়েছি। আমি বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ করব যাতে কানাই-বলাই দিঘীকে সংস্কার করে আমাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদে তীর্থস্থানকে রক্ষণাবেক্ষণ করে।” বলছিলেন রাণী দাস।
শুধু হিন্দুরাই না, মুসলিমদের কাছেও এই দীঘির তাৎপর্য অনেক। হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলিমরাও বিভিন্ন বিপদে আপদে এই দীঘিতে মানত করে থাকেন। খাদিজা বেগম নামে এক নারী জানান, “বছরখানেক আগে আমার ছেলে হারিয়ে গিয়েছিল। আমি আমার ছেলেকে পাওয়ার জন্য এখানে মানত করেছিলাম। আমার ছেলেকে আমি ফিরে পেয়েছি। তারপর থেকে আমি প্রায়ই এই দিঘীতে আসি আমার ছেলে-মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে।”
এখানে মানত করলে মনবাসনা পূরণ হয় দাবী করে তিনি বলেন, “আমি মনে করি কানাই-বলাই দিঘী একটি পবিত্র স্থান। এই বিশ্বাস নিয়েই আমি এখানে আসি।”
আরেক স্থানীয় বাসিন্দা মরিয়ম আক্তার বলেন, “এখানে যারা ভালো মন নিয়ে আসে তাদের সকল ইচ্ছে পূরণ হতে দেখেছি। আর যারা কানাই-বলাই দিঘীকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে না বা কটূক্তি করে তাদের বিপদ হয়।”
তিনি আরও বলেন, “প্রায় বিশ বছর আগে তৎকালীন কাছিপাড়া বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ক্ষিপ্ত হয়ে তার বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে এসে কানাই-বলাই দিঘী তল্লাশি করার সময় এক ছাত্র জলের নিচে অনেক ঘর বাড়ি দেখতে পায় এবং সেটা জলের নিচ থেকে কারও কাছে বলতে বারণ করে। তারপরেও সেই ছেলেটা তা সবাইকে বলে দেয়। পরে দিঘীর পাড়েই ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পরে। তার কিছুদিন পরেই সেই ছেলেটা মারা যায়।”
এমনই নানা মুখরোচক কল্প-কাহিনী প্রচলিত রয়েছে এই প্রাচীন এই দিঘীকে ঘিরে। স্থানীয় বাসিন্দা মাছুদ গাজী জানান, তিনি তার বাপ চাচাদের কাছ থেকে কানাই-বলাই দিঘীর সম্পর্কে আনেক ঘটনা শুনেছেন।
জানা যায়, কানাই-বলাই দিঘীর ঘটনাগুলো সত্যি না মিথ্যা তা পরীক্ষা করার জন্য উপজেলার মাধবপুরা গ্রামের এক মহিলা আসেন। তিনিও জলের নিচে কি আছে তা দেখার জন্য দিঘীর জলে ডুব দেন। সেই মহিলা ডুব দেয়ার পর দিঘীর পানিতে তলিয়ে যান। চার দিন পরে তার লাশ ভেসে উঠে।
এরকম অনেক অলৌকিক ঘটনা আছে এই কানাই-বলাই দিঘীকে ঘিরে। কারও বাড়িতে আনুষ্ঠান পড়লে কানাই-বলাই দিঘীর পারে গিয়ে অতিথির সংখ্যা বলে খাবার দাবারের হাড়ি, পাতিল, প্লেট চাইলে দিঘী থেকে উঠে আসতো। আবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে এসব হাড়ি পাতিল, প্লেট, দিঘীর পারে রেখে আসলে অলৌকিক ভাবে দিঘীর পানিতে চলে যেত।
স্থানীয় বাসিন্দা আসাদুজ্জামান বলেন, “এই দিঘী থেকে ক্ষতি হয়েছে গুটি কয়েক লোকের। কারণ, তারা এটাকে অবিশ্বাস করতো। কিন্তু যুগ যুগ ধরে এর সুবিধা ভোগ করে আসছে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ।” তিনি জানান, প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন কানাই-বলাই দিঘীতে। করোনা ভাইরাসের কারণে আগের চাইতে কানাই-বলাই দিঘীতে দর্শনার্থীর সংখ্যা এখন কিছুটা কম।
মুসলিমদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানও এই দিঘীকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হয়। স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মান্নান বলেন, “আমার বাড়ি এই কানাই-বলাই দিঘীর পারে। আমি ছোটবেলা থেকে দেখছি দিঘীটি। আমি দিঘীর পারে ওরস করি প্রতি বছর। আমার ওরস দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী আসে। আবার একই সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও আসেনএই দিঘীর জলে স্নান করতে।”
যুগযুগ ধরে চলে আসা বিশ্বাসের তীর্থস্থান কানাই-বলাই দিঘীটি আজ জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। সংস্কারের অভাবে অস্তিত্ব বিলীনের পথে দিঘীটি। দিঘী সংস্কারের জন্য সরকারিভাবে কিছু আর্থিক সহযোগিতা যদিও করা হয়েছে। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
ঐতিহ্যবাহী দিঘীটির এমন বেহাল দশা সম্পর্কে জানতে চাইলে পটুয়াখালী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান মোহন মিয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমি কিছুদিন আগে কানাই-বলাই দিঘী পরিদর্শন করেছি। আমার জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতাও করেছি।”
তিনি বলেন, “দিঘীতে ঘাট ও মহিলারা যাতে গোসল করে জামা কাপড় পাল্টাতে পারে তার জন্য একটি ছোট পাকা ঘর করে দিয়েছি।” কানাই-বলাই দিঘীর ইতিহাস ঐতিহ্য তথা পটুয়াখালী জেলার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থানকে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করবেন বলে তিনি আশ্বস্ত করেন।
দিঘীটির আনুমানিক দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় দুইশ মিটার ও প্রস্থ ছিল একশ চল্লিশ মিটার। যা বর্তমানে বিভিন্ন আগাছা, কচুরিপানা ও মাটিতে ভরে এক তৃতীয়াংশ হয়ে গেছে। সংস্কার না করা হলে শতাধিক বছর পূর্বের ইতিহাস তীর্থস্থান কানাই-বলাই দিঘীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। এলাকাবাসির দাবী, অচিরেই সরকার সংস্কার করে কানাই-বলাই দিঘীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবেন।