প্রচারণার নামে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের প্রতারণা,ভিডিওসহ > মোঃ ইমন খন্দকার হৃদয় ॥ নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের প্রচারণার স্বার্থে এক শিক্ষার্থীর ছবি ও বক্তব্য নিয়ে আলাদা আলাদা বিজ্ঞাপন সাঁটিয়ে প্রতারণা করে আসছে দেশের নামী-দামি ও প্রথম সারির কোচিং সেন্টারগুলো। যার পেছনে রয়েছে অর্থ কিংবা উপঢৌকন। এমন বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের সন্ধান মেলে বরিশাল নগরীতে। নিজেদের প্রতিষ্ঠানে কোচিং না করিয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে নানাভাবে প্রতিবছরই বাণিজ্য করে আসছে এ প্রতিষ্ঠানগুলো।
আর তার বাস্তব উদাহরণ বরিশাল ইউসিসি শাখা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংগুলো। তারা অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের ছবি নিয়ে নিজেদের নামে চালিয়ে তাদের শিক্ষা ব্যবসায় সম্প্রসারণ করছেন। ভর্তি পরীক্ষায় যেসব শিক্ষার্থীরা মেধাতালিকায় বিভিন্ন পজিশনে থাকে তাদের ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে লক্ষ টাকা অফার নতুবা ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ফোন ইত্যাদির উপহারের প্রলোভন দেখায় এসব ভর্তি কোচিংগুলো।
- আরো পড়ুন: ফিন্যান্স কী জেনে নিন বিস্তারিত
- আরো পড়ুন: ফিন্যান্সের ইতিহাস
- আরো পড়ুন: অর্থায়নের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা
অপরদিকে যারা পজিশনবিহীন (কিন্তু ভর্তির সুযোগপ্রাপ্ত) তারা যদি একটি ছবি তোলে, তাহলে পাওয়া যায় ৫ হাজার টাকা। এভাবেই চলে আমাদের দেশের এডমিশন কোচিংগুলোর বাণিজ্য। এমনটা ঘটেছে বরিশালের সুমন কর্তৃক পরিচালিত ইউসিসি বরিশাল শাখা। জানা যায় ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ ফারদিন খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বি ইউনিটে প্রথম হয়েছেন। এছাড়াও তিনি ঢাবিসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা হয়েছেন। তিনি লুমিনাস নামে একটি ভর্তি কোচিংয়ে প্রস্তুতি নিয়েছেন। অথচ তাকে দেখা যাচ্ছে ইউসিসি বরিশাল শাখার ব্যানারে এবং তার কর্তৃক লিখিত পত্র বক্তব্য, ভিডিও বক্তব্য নেয়া হয়েছে।
সেখানে তিনি ইউসিসির সুনামসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের তাদের প্রতিষ্ঠানে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন। শুধু ইউসিসিই নয়, ফারদিন খানের ছবি ব্যবহার করে প্রচারণা চালাচ্ছে ফোকাস, ইনডেক্স, আইকন ও লুমিনাসসহ বেশ কয়েকটি এডমিশন কোচিং সেন্টার। ইউসিসি বরিশাল শাখা দাবি করছে, ফারদিন খান তাদের ছাত্র। কিন্তু ফারদিনের নিজে বলছে তিনি লুমিনাস এডমিশন কোচিং সেন্টারের ছাত্র। তবে কেন তিনি ইউসিসি ছাত্র হিসেবে প্রচারণায় অংশ নিলেন এমন প্রস্তাবের জবাবে ফারদিন জানান, কার ওপরে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে।
ইউসিসি বরিশাল শাখা শুধু ফারদিনের ছবি ব্যবহার করেই ক্ষান্ত হয়নি, ঢাকা থেকে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বগুড়ার দুই শিক্ষার্থীর ছবিও নিজেদের ছাত্র বলে চালিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ দুই শিক্ষার্থী মেফতাউল আলম সিয়াম ও আফরোজা আরশিয়ান আইকন ও উদ্ভাসের শিক্ষার্থী। এ নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন, একজন ছাত্র কয়টি কোচিংয়ে অধ্যায়ন করে? একজন শিক্ষার্থীর এত কোচিং এ পড়া আদৌ সম্ভব কী? মেফতাউল আলম সিয়াম ও আফরোজা আরশিয়ান তারা আসলে কোন কোচিংএর প্রকৃত শিক্ষার্থী সে সম্পর্কে জানতে চাইলে উদ্ভাস শাখার জুনিয়র এক্সিকিউটিভ মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সময়ের বার্তাকে বলেন, ‘সিয়াম আমাদের ছাত্র।
সে করোনাকালীন সময় থেকে আমাদের এখানে অনলাইনে কোচিং করেছে। যা আপনি সিয়ামের থেকে নতুবা নানা মিডিয়ায় প্রকাশিত নিউজ থেকে সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেন।’ ইউসিসির এরূপ প্রতারণা সম্পর্কে জানতে চাইলে উদ্ভাস কর্তৃপক্ষ কথা বলতে রাজি হননি। এদিকে শীর্ষস্থানীয় একটি গণমাধ্যমে সিয়াম নিজেকে উদ্ভাসের প্রকৃত শিক্ষার্থী দাবী করছেন। আফরোজা আরশিয়ান সম্পর্কে জানতে চাইলে আইকন হেড অফিসের ম্যানেজার মোঃ নুরুল ইসলাম সময়ের বার্তাকে বলেন, ‘আফরোজা আরশিয়ান আমাদের ছাত্রী।
এখান থেকে সে এডমিশনের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েছে।’ এ সম্পর্কে আফরোজা আরশিয়ানের সাথে কথা বলতে চাইলে তাকে পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, যে এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের ছবি সারা বাংলাদেশে এডমিশন কোচিংগুলো তাদের নামে প্রচার করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এইসব মেধাবী শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের গর্ব কিন্তু সামান্য কিছু অর্থের জন্য তাদের নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া প্রকৃত শিক্ষার সাথে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ? তারা ভবিষ্যতে অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন ছাড়া নৈতিক দিক অবলম্বন করবে না। তাহলে তাদের শিক্ষা ও মেধার মূল্য কি রইলো জাতির কাছে? ইউসিসি বরিশাল শাখা এমনটাই করছে বিগত বছর থেকে।
এমনই দাবি করেছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক। তিনি সময়ের বার্তাকে বলেন, ‘ইউসিসি বরিশাল শাখা বলে তারা ঢাকা থেকে শিক্ষক এনে ক্লাস করান। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বরিশালের নানা কলেজের শিক্ষক ও ছাত্র তাদের এখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত থাকে। যেমনটি বিএম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম। সে দীর্ঘদিন যাবৎ ইউসিসি বরিশাল শাখার ক্লাস নিচ্ছে।’ এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউসিসি বরিশাল শাখার পরিচালক মোঃ সুমন সময়ের বার্তাকে বলেন, ‘ফারদিন খান তাদের কোচিং এ পড়াশোনা করছেন।’ বর্তমানে সারা বাংলাদেশে এডমিশন কোচিংগুলোর এই রকমের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণা।
সেই সম্পর্কে এটি শিক্ষার নৈতিক বিকাশে কেমন? সে সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মোহম্মদ গোলাম কিবরিয়া সময়ের বার্তাকে বলেন, ‘এরকমের ঘটনা সত্যিই দুঃখজনক। এটি শিক্ষার সাথে কখনোই মানানসই না। এটি নৈতিক শিক্ষার বিকাশে অবমূল্যায়ন বলে আমি মনে করি।’ বাংলাদেশ অব্যাহত এডমিশন কোচিংগুলোর এমন শিক্ষা বাণিজ্য-প্রতারণা ও সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের শিক্ষার্থী ফারদিন খান সম্পর্কে এবং এই সম্পর্কিত এটা শিক্ষার সাথে কতটুকু মানানসই? শিক্ষা কী মনুষ্যত্ব না অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার? সে সম্পর্কে জানতে চাইলে সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল সময়ের বার্তা কে বলেন, ‘এরকমের ঘটনা শুনে আমি ব্যথিত।
আমার প্রতিষ্ঠানের শুধু ফারদিন খান না আরো কয়েকজন ঢাবিতে চান্স পাওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে এমন করেছে এই কোচিংগুলো। এটা শিক্ষার সাথে কোনদিন মানানসই না। শিক্ষা মনুষত্ব অর্জনের জন্য সব সময়। কখনোই অর্থের জন্য না। যারা এই অনৈতিক কাজের সাথে জড়িত তাদের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ বলে আমি মনে করি।’ বরিশালে অব্যাহত এডমিশন কোচিংগুলোর এমন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কিনা? সে সম্পর্কে কাছে জানতে চাইলে বরিশাল জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোঃ সোহেল মারুফ সময়ের বার্তা কে বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে জানলেও এটা আমাদের হাতে নেই।
- আরো পড়ুন: অভিবাসন কী, অভিবাসী শ্রমিক ও অভিবাসনের গুরুত্ব
- আরো পড়ুন: বাংলা ব্যাকরণ
- আরো পড়ুন: শূন্য থেকে শুরু বিসিএস প্রস্তুতির
তবে যদি কোনো শিক্ষার্থী জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়, যে তার সাথে প্রতারণা হয়েছে বা যে কোনো চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। তবে অবশ্যই বরিশাল জেলা প্রশাসন তার পাশে আছে। আর এই কোচিং বিষয়গুলো আমরা অবশ্যই যাচাই করে দেখব এবং এগুলো বন্ধ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করি।’ বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি প্রফেসর শাহ সাজেদা সময়ের বার্তাকে বলেন ‘শিক্ষা কখনোই অর্থ উপার্জনের জন্য না। শিক্ষা মানুষ হওয়ার জন্য। শিক্ষা বিশ্বকে জানার জন্য। যে সমস্ত এডমিশন কোচিংগুলো এই অসৎ কাজগুলো করছে অবশ্যই সেটি শিক্ষা নৈতিকতার বাইরে।
https://www.facebook.com/somoyerbartabd/videos/683200339343823
আমি বলব জেলা প্রশাসন, শিক্ষা বোর্ড, পাশাপাশি শিক্ষা ক্ষেত্রে যেসমস্ত কর্মকর্তারা নিয়োজিত তারা এই বিষয়ে অবগত হয়ে অবশ্যই কোচিং গুলোকে নিয়মিত মনিটরিং করবে। যদি কিছু অসৎ কিছু মনে করে তবে অবশ্যই শিক্ষার্থীদের স্বার্থে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আমি আশাবাদী।’ তিনি আরো বলেন, শিক্ষা হোক প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবন আলোকিত করার উদ্দেশ্যে। শিক্ষা কখনোই অর্থ উপার্জন বা অনৈতিক কাজের উপর ভিত্তি করে শিক্ষার সম্প্রসারণ এটি কখনোই শিক্ষার মূল নৈতিকতা নয়।
লুমিনাসের পরিচালক তাহসিন সিফাত সময়ের বার্তাকে বলেন, ‘ফারদিন খান নিয়মিত তার কোচিং সেন্টারে পড়াশোনার করেছেন। যার পর্যাপ্ত প্রমানও আছে তার কাছে। অথচ রহস্যজনক কারণে ফারদিন ইউসিসি সহ বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে আলাদা আলাদা নানা মন্তব্য করেছেন। যা আসলেই দুঃখজনক। তবে ফারদিনের বাবা শাহিন লুমিনাসের পরিচালক তাহসিন সিফাতের কাছে ফোন করে দুঃখপ্রকাশ করেছেন বলে বিষয়টি নিশ্চিত করেন পরিচালক সিফাত।
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে।