জলে জন্ম, জলেই মৃত্যু, জলেই তাদের বসবাস। মৃত্যুর পর মরদেহ ভাসিয়ে দেয়া হয় নদী কিংবা সাগরে। বলছি মানতা সম্প্রদায়ের জীবনের কথা। উপকূলের এক ভিন্নধর্মী জনগোষ্ঠী ‘মানতা’। আজ এ ঘাটে তো কাল অন্য ঘাটে। নেই কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা।
ওদের জীবন নৌকার জীবন। স্ত্রী, সন্তান, মা-বাব সবাইকে নিয়ে নৌকায় বসবাস মানতাদের। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবই নৌকার ছৈয়ের নিচে। নদী-খাল কিংবা সাগরে দেখা মেলে এদের। এমনকি ঝড়, বন্যা, তুফানেও নৌকাতেই বসবাস করতে হয় তাদের।
পটুয়াখালী জেলার রাঙাবালী উপজেলার একটি ইউনিয়ন চর মন্তাজ। চর মন্তাজের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বাস করে মানতা সম্প্রদায়ের মানুষেরা। আমাদের দেশের প্রধানত উপকূলবর্তী জেলাগুলোর নদীর তীর ধরে হাঁটতে থাকলে দেখা মিলবে সারি সারি নৌকা।
প্রতিটি নৌকাতে একটি করে পরিবার। মানতা সম্প্রদায়ের পরিবারের সমস্ত সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না মিশে আছে ঐ ছোট্ট নৌকাটি ঘিরে। এর বাইরে তাদের কোন বৃত্ত নেই। ধর্মে তারা মুসলমান। তবু জীবন যাত্রা বিচিত্র ঢঙে গড়ে ওঠা এই সম্প্রদায় মানতা নামে পরিচিত।
মানতাদের জীবিকার প্রধান উপায় মাছ ধরা। জাল, মাইজাল, বড়শি নিয়ে মাছ ধরে পুরুষেরা। নারীরাও এ কাজে কম পটু নন। একটু বয়স হলেই সন্তানেরাও মাছ ধরায় সাহায্য করে বাবা-মাকে। আর্থিক দৈন্যতায় স্কুলে যাওয়া হয়ে ওঠে না বেশির ভাগেরই। পেটের খোড়াক রোজাগানোর তাগিদটা তাদের এতই বেশি যে ক্ষুধার কাছে বিদ্যার প্রসঙ্গ থেমে যায়।
সম্প্রদায়টির বেশিরভাগের রয়েছে নাগরিকত্ব পরিচয়ের সঙ্কট। সাম্প্রতিককালে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে সম্প্রদায়টির একটি অংশ এলাকার বিভিন্ন আশ্রয়ণ প্রকল্পে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে। কিন্তু এতে কেবল আশ্রয়ই মিলেছে। মেলেনি অন্যান্য নাগরিক সুবিধা।
বিশেষ করে শিক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার থেকে তারা এখনও বঞ্চিত। আজও এ সম্প্রদায়টির শিশুদের বয়স ছয়-সাত-আটে পা দিলেই জীবিকার তাগিদে হাতে তুলে নিতে হয় নৌকার বৈঠা। জাল ফেলতে হয় নদীতে। মাছ ধরায় হতে হয় দক্ষ। ফলে এরা বঞ্চিত হয় স্বাক্ষরজ্ঞান থেকে। শিক্ষা না থাকায় জীবনের পদে পদে হতে হয় বঞ্চিত-লাঞ্ছিত।
তাদেরও জন্ম নদীর বুকে, নদীতে বেড়ে ওঠা, নদীতেই মৃত্যু। আবার মৃত্যুর পর লাশগুলো তাই ভেসে যায় নদীর জলে। নয়তো নদীর তীরে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রাখা হয়। নদী কিংবা সমুদ্রের বুকে মাছ ধরার সব উপকরণ নিয়ে তারা ছুটে চলে জীবনের তাগিদে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে তারা মাছ ধরে।
পটুয়াখালীর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা গেছে ওরা ভেসে চলে পানপট্টি, চরমন্তাজ, গলাচিপা, কালাইয়া, বগা, বদনাতলী, উলানিয়াসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদী,চর ও মোহনাগুলোতে। শুধু পটুয়াখালীতেই এই সম্প্রদায়ের কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক পরিবার রয়েছে।
দেশের নাগরিক হয়েও কোনো নাগরিক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না তারা। সরকার যদি তাদের পুনর্বাসনের সুযোগ করে দিত তাহলে তারা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেত। শুধু তরুণ প্রজন্মই নয়, মানতাদের বৃদ্ধরাও অনেকে চান শেষ জীবনে অন্তত মাটির গন্ধে দিন কাটাতে।
মানতা সম্প্রদায়ের অনেকেই জানেন না তাদের পৈত্রিক ভিটে কোথায় ছিল, আদৌও ছিল কিনা। যারা নিজেদের ইতিহাস জানেন, তারা বলছেন নদীভাঙন তাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। ফলে বাধ্য হয়েই এই নৌকার জীবন বেছে নিতে হয়েছে তাদের।
এভাবেই আজ এখানে তো কাল ওখানে, ঘাট থেকে ঘাটে, জনপদ থেকে জনপদে ভেসে বেড়াচ্ছেন তারা। নৌকাতেই চলছে তাদের ঘরকন্না, হাসিকান্না, ঈদ-পার্বণ সব। এমনকি বিয়েসহ অন্যান্য সামাজিক উৎসবও হয় নৌকাতেই।
মানতা সম্প্রদায়ের রাবেয়া খাতুন জানান, “আমাগো লেখাপড়া কোন বিদ্যা নাই, আমাগো গুড়াগাড়াগো (ছেলেমেয়ে) কি পড়ামু? একটু কোরয়ান শরীফ পড়াইতে পারলে ভাল হইত। আমরা মইরা গেলে আমাগো গুড়াগাড়ারা মাথার কাছে বইয়া একটু কোরয়ান শরীফ তেলাওয়াত করতে পারত। গুড়াগাড়ারা অসুখ হইয়া মইরা গেলে মাটি দিমু কোথায়?”
মৃত্যুর পরে সৎকারের কোন স্থায়ী জায়গা নেই অভিযোগ করে তিনি বলেন, “অনেক সময় নদীর চরে সরকারি জায়গায় মাটি দেই, আমাগো কোন কবর স্থান নাই, যে সেই খানে মাটি দিমু।”
বেঁচে থাকার জন্য সকল মৌলিক অধিকারের স্বয়ংসম্পূর্ণতা না থাকায় অত্যান্ত মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে এখানকার বাসীন্দাদের। মানতা সম্প্রদায়ের রহীম গাজী জানান, “কোনদিন নদীতে মাছ থাহে কোনদিন থাহে না, যেদিন মাছ পাই সেদিন খাইতে পারি আর যেদিন মাছ পাইনা খাইতে পারি না।”
তিনি বলেন, “আমাগো অনেক কষ্ট হয় সংসার চালাইতে। সরকার আমাগো কোন সাহায্যে সহযোগিতা করে না। আমাগো নামে চাউল আয় কিন্তু আমরা পাই না। খাইয়া হালায় অন্য লোকে। অনেক সময় ঝড় বন্যা মাথায় লইয়া নদীতে নদীতে থাহি। কখন কি হইয়া যায় এক আল্লাই জানে। আল্লা ছাড়া আমাগো দেখার কেউ নাই।”
সরকারের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে রহীম গাজী বলেন, “সরকার যদি আমাগো আবাসনের ব্যবস্থা করে দিত তাহলে আমরা আর নৌকায় নৌকায় থাকতে হইত না। সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। আমাগো আবাসনের ব্যবস্থা করে দিন।”
মানতা সম্প্রদায়ের রহিমা আক্তার জানান, “নৌকায় থাহি, নৌকায় চলি। মরণ বাঁচন নৌকায়। যদি আল্লায় রিজিক দেয় খাই আর না দেলে না খাইয়া থাহি। খুব কষ্টে আমরা চলি। এক শুধু আল্লাই জানে আমাদের কষ্টের কথা।
কখনো কোন ত্রাণ পান কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “জাইল্লা (জেলে) নামে কোন চাউল-টাউল আমরা পাই না। যে সময় আল্লায় যা দেয় তাই খাই। রিলিফ আইলে আমরা পাই না। বলে তোমরা ভাষানী, তোমাগো নামে কোন রিলিফ নাই।
শুধু খাবারের সংকটই না, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রের এখানে রয়েছে দারুণ সমস্যা। এরা বেড়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে। নৌকাতে জীবন কাটানোর ফলে এরা স্বাভাবিক পরিবেশ পায় না। ছোট ছোট শিশুরা ভোগে নানা অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগে।
তবে বয়স্কদের রোগ বালাই নেই বললেই চলে। নৌকাতেই গর্ভবতী নারীরা সন্তান প্রসব করেন। জটিল সমস্যা হলে হাসপাতালে যেতে হয়। অনেক প্রসূতি নারীই আবার হাসপাতালে যেতে চান না। ফলে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে হরহামেশাই।
অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি নিরাপত্তাজনিত সমস্যা এখানে প্রবল হয়ে উঠেছে। এদের জীবন প্রায়ই অনিশ্চিত। নদীতে অহরাত্রি তাদের দস্যুর ভয়ে কাটাতে হয়। যখন উপকূলের কাছাকাছি থাকেন তখন আবার চোর-ডাকাতদের ভয়। ঝড়-জলোচ্ছাসের সময় এরা পায় না কোনো সতর্কতা সংকেত। তাই দুর্যোগের মধ্যেও তাদের থাকতে হয় নদীতে।
পটুয়াখালী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, “মানতা সম্প্রদায় চাইলে তাদের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিতে সব নাগরিক সুবিধা দেয়ার কথা আমরা চিন্তা করবো। আর শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারেও আন্তরিক বলে জানালেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।