বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকে বড় করে লেখা আছে ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ।’ তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্নকথা। সামনে আলোর পথ লেখা থাকলেও ভেতরে যেন পুরোটাই অন্ধকারে ভরা। প্রধান গেট থেকে দুর্নীতি শুরু হলেও শেষটা কোন পর্যন্ত তার সীমারেখা নেই।
আসামিদের সঙ্গে দেখা করতে লাগে টাকা। খাবারের দাম বাইরের চেয়ে তিন থেকে চারগুণ। যাচ্ছেতাই খাবার হলেও বাধ্য হয়ে বেশি দামে কিনতে হয় ক্যান্টিন থেকে। যাদের আর্থিক অবস্থা দুর্বল তাদের জন্য বরিশাল কারাগার যেন নরক।
এখানে টাকা দিলে মেলে ভালো বিছানা। না দিলে থাকতে হয় বাথরুমের সামনে কিংবা ম্যাটের ইচ্ছামাফিক জায়গায়। কারাগারের ভেতরের মেডিকেল কক্ষে কোনো অসুস্থ আসামি থাকে না, যাদের টাকা আছে কেবল তাদের ভাগ্যেই মেলে আরামদায়ক বিছানা। আর মেডিকেলের বিছানা পেতে লবিং তদবির করতে হয়।
এখানে সহজেই মিলে নেশা, ইয়াবা, গাঁজা ও ঘুমের ট্যাবলেট। এসবের লেনদেন হয় পিসি বইয়ের মাধ্যমে। নির্দিষ্ট কারারক্ষী ও কয়েদিদের দিয়ে চলে মাদক বাণিজ্য। কারাসূত্রে জানা যায়, খাবার তালিকা অনুযায়ী প্রতিদিন সকালে একজন কয়েদি ১১৬ গ্রাম ও হাজতির জন্য ৮৭ গ্রাম আটার রুটি, ১৪ গ্রাম আখের গুড়, দুপুরে কয়েদির জন্য ২৯১ গ্রাম ও হাজতির জন্য ২৪৭ গ্রাম চালের ভাত, ডাল, সবজি এবং ২৯ গ্রাম ওজনের মাছ অথবা মাংস দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। রাতেও প্রায় একই মেন্যু। প্রতি মাসে ২০ দিন মাছ এবং ১০ দিন মাংস খাওয়ানোর নিয়ম রয়েছে। ১০ দিনের মধ্যে আবার ৪ দিন গরু, একদিন খাসি এবং ৫ দিন মুরগির মাংস খাওয়ানোর কথা।
বন্দিদের দাবি, খাবারের এসব মেন্যু তালিকাতেই সীমাবদ্ধ। এখানে খাবারের মাপ কম দেওয়াসহ নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে বছরের পর বছর। তবে রক্ষীদের নির্যাতনের ভয়ে কেউ টুঁ শব্দ করেন না।
যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার জয়নাল আবেদীন ভুঁইয়া। তিনি বলেন, ‘খাবারের মান অনেক ভালো। মেডিকেল বেডে কেবল অসুস্থ আসামিরাই থাকে। টাকা দিয়ে মেডিকেল কক্ষে থাকার সুযোগ নেই।’
দীর্ঘদিন ধরে থাকা জেলখানার সহকারী সার্জন এসএম মিরাজ হোসেন মেডিকেলের সিট বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে এসএম মিরাজ হোসেনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।’
সদ্য কারামুক্ত বাকেরগঞ্জ উপজেলার হারুন হাওলাদার বলেন, ‘পারিবারিক একটি মামলায় এক মাস কারাবন্দি ছিলাম। এক মাসে থাকা খাওয়া বাবদ চল্লিশ হাজার টাকা জেলখানার পিসি বইয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করেছি। অথচ আসামিদের খরচ বহন করে সরকার।’
তিনি বলেন, ‘মেডিকেলে এক মাসের জন্য আট হাজার টাকা দিতে হয়েছে। বাকি টাকা ক্যান্টিনের খাবার বিল ও পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে এলে দেখার ঘরে দায়িত্বরতদের দিতে হয়েছে। এতে চল্লিশ হাজার টাকা এক মাসে খরচ হয়।’
উজিরপুর উপজেলার বাসিন্দা আব্দুর রহিম (৬২) জায়গাসংক্রান্ত মামলায় সাত দিন ছিলেন বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে। তিনি বলেন, ‘সারাজীবন শুনেছি জেলখানা মানে সরকারি ভাত। অথচ সাত দিনে আমার আট হাজার চারশ টাকা খরচ হয়েছে। মেডিকেলের সিট ভাড়া বাবদ দিয়েছি পাঁচ হাজার টাকা। বাকিটা খাবার বাবদ। কারণ জেলখানায় যে খাবার দেয়, তা মুখে দেওয়ার মতো নয়।’
সদ্য কারামুক্ত একাধিক আসামির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘মাসিক চুক্তিতে প্রতিটি ওয়ার্ড ও মেডিকেলের কক্ষ বেচাকেনা হয় আসামি গুণে। মানুষ বেচাকেনার এ বাণিজ্যে ম্যাটদের (কয়েদি) সঙ্গে সরাসরি জড়িত কারারক্ষী। আর মেডিকেল কক্ষের নিয়ন্ত্রণ করেন সহকারী সার্জন এসএম মিরাজ হোসেন। দীর্ঘদিন ধরে ফার্মেসির দায়িত্বে থাকলেও তার মূল কাজ মেডিকেলের সিট বাণিজ্য। টাকার ভাগ পান কারারক্ষী থেকে জেলখানার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
মেডিকেল কক্ষ ছাড়াও আমদানি-রপ্তানি ওয়ার্ডের আসামি বেচাকেনা চলে আসছে বছরের পর। সাত দিন, পনেরো দিন ও এক মাস চুক্তিতে আমদানি-রপ্তানি ওয়ার্ডে চলে আসামি বেচাকেনা। আর এই আসামি বেচাকেনার বাণিজ্য নিয়ে ম্যাটের (কয়েদি) মারামারি নিত্যদিনের ঘটনা।
কারাগেটের ক্যান্টিনে আসামিদের খাবারের দাম কয়েকগুণ বাড়তি রাখলেও ভাউচার দেওয়া হয় না। এ নিয়ে কথা বাড়ালে আসামিদের খাবার দেয় না ক্যান্টিন কর্তৃপক্ষ। পোশাক কিংবা বিছানা-চাদরের জন্যও গুনতে হয় টাকা। আর ভেতরের ক্যান্টিনে রান্না করা খাবারের দাম বাইরের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি। কেউ প্রতিবাদ করলে পড়তে হয় ঝামেলায়। তাই মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া উপায় থাকে না বন্দিদের।
কারাগারে আসামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যেন আরেক দুষ্প্রাপ্য বিষয়। নিয়মমাফিক স্লিপ কেটে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তারপর পাঁচ থেকে দশ মিনিট দেখা মেলে। অনেক সময় আসামি খুঁজে পাওয়া যায় না, এমন কথা শুনে চলে যেতে হয় পরিবারের সদস্যদের। তবে দুইশ থেকে পাঁচশ টাকা দিলে অপেক্ষা করতে হয় না এক মুহূর্তও। আসামি ঘুমানো থাকলেও ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে আসা হয়।
এসব অনিয়মের বিষয় জানতে চাইলে জেল সুপার রত্না রায় বলেন, ‘সব অভিযোগ মিথ্যা।’ এরপরই তিনি ফোন কেটে দেন।