মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নেই। এখানে যে অপরাধীরা বন্দী থাকেন, কারাগারের ভিতর বিলাসবহুল জীবন কাটানোর সুযোগ পান তারা। নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠিন না হলেও এই কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি কোনও বন্দি। কোথায় রয়েছে বিলাসিতায় পরিপূর্ণ এই কারাগার?
নরওয়ের দক্ষিণ-পূর্বে ওসলো থেকে সড়কপথে আড়াই ঘণ্টা যাওয়ার সময় পথের দু’পাশে পড়ে যবের ক্ষেত, খামারবাড়ি, পাইনের ঘন জঙ্গল। ছবির মতো এই দৃশ্য পার করে যেতেই শহরের প্রান্তে দেখা মিলবে প্রায় ৭৫ একর জমির উপর নির্মিত কারাগার হাল্ডেন প্রিজনের।
১০ বছর ধরে তৈরি করা হয় নরওয়ের এই হাল্ডেন কারাগার। কারাগার নির্মাণে ভারতীয় মুদ্রায় খরচ হয়েছিল ২১০৮ কোটি টাকারও বেশি। এই কারাগারে যে বন্দীরা থাকবেন, তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই কারাগার নির্মাণ করা হয়েছিল। বন্দিজীবন কাটানোর পর বাইরে বেরিয়ে তারা যেন সহজেই জীবনের মূলস্রোতে ফিরে যেতে পারেন, এই কারাগার তৈরির মূল লক্ষ্য ছিল সেটাই।
২০১০ সালের মার্চ মাসে হাল্ডেন কারাগারে প্রথম বন্দী আসেন। সেই বছর এপ্রিল মাসে নরওয়ের তৎকালীন রাজা পঞ্চম হ্যারল্ড এই কারাগারের উদ্বোধন করেন। ২৪৮ থেকে ২৫২ জন বন্দীর একসঙ্গে এই কারাগারে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
হাল্ডেন জেলের চারদিকে নিরাপত্তার জন্য কাঁটাতারের কোনও বেড়া নেই। সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন না বন্দুকধারী নিরাপত্তারক্ষী। সদর দরজার কাছে লাগানো রয়েছে একটি ইন্টারকম। সেই ইন্টারকমের মাধ্যমে রিং করলে জেলের সদর দরজার তালা নিজে থেকেই খুলে যায়।
হাল্ডেন কারাগারে অপরাধীদের থাকার জন্য রয়েছে আলাদা ঘর। বিছানা, এলইডি টিভি থেকে শুরু করে ঘরের সঙ্গে রয়েছে আলাদা বাথরুমও।
১১০ বর্গফুটের প্রিজন সেলের প্রত্যেকটির ভিতর রাখা একটি টেবিল এবং ফ্রিজ়। ১০ থেকে ১২টি সেল নিয়ে এক একটি এলাকা ভাগ করা রয়েছে, যেখানে ওই সেলের বন্দীরা অবসর সময়ে হাঁটাচলা করতে পারেন। আলাদা রান্নাঘর এবং একটি কমন লিভিং রুমও রয়েছে ওই নির্দিষ্ট এলাকাগুলিতে।
লিভিং রুমে রয়েছে ভিডিয়ো গেম খেলার ব্যবস্থা। বসার জন্য রয়েছে আরামদায়ক সোফা। বন্দীরা জেলের মধ্যে নিজেদের ইচ্ছা মতো রান্না করতে পারেন।
বন্দীরা সর্বাধিক ১২ ঘণ্টা তাদের সেলের ভিতর থাকতে পারেন। দিনের বাকি সময়টুকু তারা সেলের বাইরে নানা ধরনের কাজকর্ম করেন। এমনকি, সেলের বাইরে বেশি সময় কাটালে সেই বন্দীদের দিনপ্রতি প্রায় ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়।
হাল্ডেন কারাগারে বন্দিদের জন্য আলাদা করে তৈরি করা হয়েছে ‘অ্যাক্টিভিটিস হাউস’। সেখানে রয়েছে ফুটবল খেলার মাঠ, হাঁটার জন্য রয়েছে ‘জগিং ট্রেল’। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই বিশেষ ‘হাউস’ খোলা থাকে।
কাঠের উপর খোদাইয়ের কাজ থেকে শুরু করে গান শেখানো এবং রান্না শেখানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে বন্দীদের। জেলের ভিতরের গ্রন্থাগারে বইয়ের পাশাপাশি রাখা থাকে নানা ধরনের পত্রিকা। গান শোনা এবং সিনেমা দেখার জন্য থাকে সিডি এবং ডিভিডি।
বন্দীদের শরীরচর্চা করার জন্য তৈরি করা হয়েছে জিম। বিনোদনের জন্য রয়েছে ‘রক ক্লাইম্বিং ওয়াল’ও। দেওয়ালে বসানো পাথর বেয়ে ওঠানামা করা যায় এর মাধ্যমে।
জেলে সাধারণত আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে বন্দিদের দেখা করার সময় বাঁধাধরা থাকে। কিন্তু হাল্ডেন কারাগারের নিয়ম অন্য রকম। বন্দিরা তাদের সঙ্গী, পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়দের সঙ্গে নিজেদের মতো সময় কাটাতে পারেন।
২০১২ সালের গণনা অনুযায়ী, হাল্ডেন কারাগারে মোট ৩৪০ জন কর্মী রয়েছেন। শিক্ষকের পাশাপাশি কর্মী হিসাবে সেখানে রয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মী এবং নিরাপত্তারক্ষীরাও। রক্ষীদের ৫০ শতাংশ মহিলা। কারাগারের ভিতর রক্ষীরা বন্দুক ছাড়া ঘোরাফেরা করেন। এমনকি বন্দিদের সঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়াও করেন তারা।