শিক্ষাকতা পেশা ব্যতিক্রমী নেশা যার! মুহম্মদ ইমন খন্দকার হৃদয় ।। বৃক্ষের সাথে মাটির সম্পর্ক, আলোর সাথে অন্ধকারের, ফুলের সাথে সৌন্দর্যের মিলবন্ধন আর একজন শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থীর সম্পর্ক। একজন শিক্ষকই পারে, একজন শিক্ষার্থীর জীবন বদলাতে, তাকে স্বপ্ন দেখাতে, জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলোতে তার পাশে থাকতে।
একজন শিক্ষকই পারে, একজন শিক্ষার্থীকে মানুষের মতো মানুষ করতে। যিনি তার সততা, আদর্শ ও ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষার্থীর মন জয় করে নেন। এমনই একজন আদর্শিক শিক্ষক প্রফেসর মো. মোস্তফা কামাল। যিনি দক্ষিণবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের অধ্যক্ষ। আজ তার কর্মজীবনের শেষ দিন ।
প্রায় তিরিশটি বছর তিনি শিক্ষাকতা পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। তার চাকুরিজীবনের অবসান হলেও, তিনি কখনো শিক্ষাকতাকে চাকুরি হিসেবে দেখেননি। তার চোখে শিক্ষকতা পেশাই ছিল তার ধর্ম। শিক্ষার্থীদের মানুষের মত মানুষ করাই ছিল তার কর্ম। আজ আমরা তার সফলতার ছোটগল্প বলবো। প্রফেসর মো. মোস্তফা কামাল ১৯৬১ সালের ৪ ঠা জুলাই ঝালকাঠি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
তার পিতাঃ মো. আব্দুল হাই মোল্লা; মাতাঃ নুরজাহান বেগম। পরিবারের তিন ভাই বোনের ভিতর তিনি ছিলেন বড়। তার বাবা ছিলেন একজন কৃষক। তাদের সংসারে তেমন টানাপোড়ন না থাকলেও সংগ্রাম ছিল প্রখর। ছোটকাল থেকেই প্রফেসর মো. মোস্তফা কামাল ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও মুক্তমনা।
পড়ালেখায় প্রবল আগ্রহ দেখে তার পিতা স্থানীয় জে.বি. আই ইউনিয়ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভর্তি করিয়ে দেন। এই বিদ্যালয় থেকেই তার শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ি শুরু হয়। এরপরে তিনি ঝালকাঠি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ভর্তি হন।
এখান থেকে ১৯৮১ সালে তিনি মাধ্যমিক পাস করেন। মাধ্যমিক পাস শেষে বরিশালের ঐতিহ্যবাহী সরকারি ব্রজমোহন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৮৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৮৮ সালে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক সম্মান এবং ১৯৯০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
প্রফেসর মো. মোস্তফা কামাল যখন মাধ্যমিক বিদ্যালয় পড়াশোনা করেন। তখন ওই স্কুলের বাংলার শিক্ষক মোঃ ফজলুর রহমানের বাংলার লেকচার ও তার ব্যক্তিত্ব মোস্তফা কামালকে খুবই প্রভান্বিত করে। তাকে দেখেই তার শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন হৃদয়ে দানা বাঁধতে শুরু করে এবং ওই শিক্ষকের কারণেই বাংলা বিষয়ের প্রতি মোস্তফা কামালের আগ্রহ ও ভালোবাসা জন্মায়। তাই ছোটকাল থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক ইত্যাদি পড়তেন।
তিনি চেষ্টা করতেন তার শিক্ষক ফজলুর রহমানের মত শিক্ষক হতে। অনেক চেষ্টার পরে তিনি চাকুরি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, ১৯৯৩ সালে ঝালকাঠি সরকারি মহিলা কলেজে বাংলার প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। এখান থেকেই তার কর্মজীবনের শুরু। এরপরে ঝালকাঠি সরকারি কলেজে, চাখার কলেজে প্রায় ২২ বছর শিক্ষকতা করেন।
সর্বশেষ ২০১৫ সালে সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজে বাংলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। তার সততা, কর্মদক্ষতা, স্পষ্টবাদিতার পুরস্কারস্বরূপ ২০১৯ সালে সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে পদোন্নতি পান। তখনই বিশ্বব্যাপী মরনঘাতী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বিশ্ব একটি মারাত্মক পরিস্থিতির ভিতরে পড়ে।
সেই কঠিন পরিস্থিতির ভিতরে মোস্তফা কামালকেও পড়তে হয়। তবুও তিনি হার মানেননি। করোনার কারণে যাতে কলেজ পরিচালনা ও শিক্ষার্থীদের ক্ষতি না হয় তাই তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কলেজ পরিচালনা করেছেন।
করোনার ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠে মাত্র অল্প কয়েক বছরের তিনি হাতেম আলী কলেজের পারিপার্শ্বিক চিত্র বদলে দেন। তারই ধারাবাহিকতায় কলেজের ফলাফলে, কলেজের স্থাপনায়, কলেজের বিভিন্ন পরিকল্পনায় আসে আমূল পরিবর্তন। তার সময়েই হাতেম আলী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে সেরা ফলাফলের রেকর্ড গড়ে ।
২০২১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় হাতেম আলী কলেজের পাশের হার ছিল ৯৮.০৯%, ২০২২ সালে ৯৬.৫০%, ২০২৩ সালে ৯৫.৫৩% এবং ২০২৪ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় হাতেম আলী কলেজ স্মরণকালের সেরা ফলাফল করবে বলে মোস্তফা কামাল আশা করেন। এই রেকর্ডমুখী ফলাফল করা একমাত্র সম্ভব হয়েছে শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখী করার কারণে।
কলেজের অনার্স ও মাস্টার্স এর ক্ষেত্রে তেমন তার অর্জন না থাকলেও উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলের কারণে দেশজুড়ে তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন। যার কারণে সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ বর্তমানে বরিশালের সেরা ৫টি কলেজের মধ্যে অন্যতম একটি কলেজ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এছাড়াও কলেজের স্থাপনায় তিনি ভূয়সী প্রশংসার দাবিদার। তার হাত ধরেই এসেছে কলেজের উন্নায়নে সার্বিক পরিবর্তন।
তার হাত ধরেই কলেজের নতুন দৃষ্টিনন্দন গেট নির্মিত হয়েছে, সাইকেল গ্যারেজ নির্মাণ, প্রফেসর হানিফ চত্বর নির্মাণ, অত্যাধুনিক বায়াতুল মামুর মসজিদ নির্মাণ; যেখানে ছাত্রীদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে, মুক্তমঞ্চ নির্মাণ, ছাত্রীদের জন্য অত্যাধুনিক কমনরুম নির্মাণ, কলেজের বাথরুম গুলোর সংস্কার, অধ্যক্ষ কক্ষ আধুনিককরণ, কলা ও বাণিজ্য ভবনের ছাদ নির্মাণ, লাইব্রেরী ভবন ও বঙ্গবন্ধু কর্ণার স্থাপন, বিজ্ঞান ভবন সৌন্দর্যকরণ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় CEDP প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দকৃত অর্থের সুষম বণ্টন,
ওই প্রকল্পের অর্থ দিয়ে কলেজের অত্যাধুনিক পাঁচটি ক্লাসরুম নির্মাণ করা হয়েছে। কলেজকে স্মার্ট প্রযুক্তির আওতায় আনতে বিভিন্ন ক্লাসে স্মার্টবোর্ড স্থাপন, ল্যাপটপ, ডেক্সটপ, কম্পিউটার, সিসি ক্যামেরা সংযোজন, বিজ্ঞান শিক্ষা সম্প্রসারণে ছয় তলা বিশিষ্ট একটি ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। এছাড়াও অনেক প্রকল্প ও পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
অষ্টম শ্রেণি 2024 সালের নতুন বই থেকে প্রশ্ন উত্তর জানতে ক্লিক করুন
যা মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ পেলে বাস্তবায়ন হবে। তার ভিতর উল্লেখযোগ্য বঙ্গবন্ধু মুরাল ও শহীদ মিনার স্থাপন, ক্যাফেটেরিয়া ও টি.এস.সি ভবন নির্মাণ, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কুতুব উদ্দিন ভবনকে চারতলা করণ, কলেজের তিনটি পুকুরের পাশে হাটার রাস্তা নির্মাণ ও পুকুররগুলোকে সৌন্দর্যকরণ, কলেজের চারপাশে উঁচু সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, শিক্ষক ডরমেটরি ভবন নির্মাণ,
শহীদ আলমগীর ছাত্রনিবাসে ছাত্রদের জন্য নতুন পাঁচ তলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ ইত্যাদি।
হাতেম আলী কলেজের ঐতিহ্য ও আয়তন অনুযায়ী এখনো অনেক সংকট রয়েছে। কলেজের যে ভবন ও স্থাপনা থাকার দরকার ছিল তা এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। মোস্তফা কামালের প্রত্যাশা পরবর্তীকালে যারা কলেজ পরিচালনায় আসবে তারা সংকটগুলোকে সমাধান করবেন।
সকলের প্রচেষ্টায় হাতেম আলী কলেজ হয়ে উঠবে দেশ সেরা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষকতা জীবনে মোস্তফা কামালার সবথেকে ভালোলাগা ও ভালোবাসার স্থান ছিল তার ক্লাসরুম। যেখানে তিনি তার মনের ভাবগুলোকে শিক্ষার্থীদের মাঝে আপন মনে প্রকাশ করতে পারতেন। তার কাছে তার ক্লাসরুমই ছিল তীর্থস্থান। জীবনের সবথেকে সেরা সময়গুলো তিনি ক্লাসরুমে উপভোগ করেছেন। ক্লাসরুমেই ছিল তার কাছে অনাবিল আনন্দের শেষ ঠিকানা।
তিনি তার জীবনের ক্লাসরুম নিয়ে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা বলেছেন, ” একদিন আমার গায়ে প্রায় ১০৪ ডিগ্রির উপরে জ্বর ছিল তা নিয়ে আমি ক্লাসরুমে প্রবেশ করেছি। ক্লাস নেওয়ার সময় আমার শরীর ঘেমে যায়, আমার জ্বর ছেড়ে যায়। কিন্তু যখন আমি আবার ক্লাস থেকে বেরিয়েছি, তখন আমার আবার জ্বর শুরু হয়েছে “।
তিনি তার অবসর জীবনে প্রিয় দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অনেক মনে করবেন। সেটি হল ঝালকাঠি সরকারি মহিলা কলেজ যেখান থেকে তার শিক্ষকতা জীবনের শুরু এবং সরকারি শহীদ হাতেম আলী কলেজ যেখান থেকে তার শিক্ষকতা জীবনের উপসংহার। তার অবসর জীবন নিয়ে তার কোন দুঃখ নেই কিন্তু প্রত্যাশা রয়েছে হাজারো। তিনি আবারও ফিরে যেতে চান তার প্রিয় সেই ক্লাসরুমে।
সমাধান ২ | শ্রেণী ৮ম | বাংলা | অধ্যায় ১ | প্রয়োজন বুঝে যোগাযোগ করি
যুক্ত হোন আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে এখানে ক্লিক করুন। এবং আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন ফেইজবুক পেইজে এখানে ক্লিক করে