৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় হার না মেনে রাজপথে ট্রাফিক সদস্যরা

ট্রাফিক ইন্সপেক্টর সরোয়ার দায়িত্ব পালন করছিলেন। হঠাৎ অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন। বাধ্য হয়ে বাসায় চলে যান। কিন্তু বাসায় যাওয়ার পর থেকে শুরু হয় তার পাতলা পায়খানা। তা চলে কয়েক দফায় কয়েক ঘণ্টাব্যাপী। শরীর নিস্তেজ হতে শুরু করে। এরপর তিনি খাবার স্যালাইন পানিতে গুলিয়ে খাওয়া শুরু করেন। তারপর কিছুটা স্বস্তি মেলে।

সোমবার (২৯ এপ্রিল) কড়া রোদের মধ্যে গুলশানের যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে এভাবেই টিআই সরোয়ার অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই কথাই ঢাকা মেইলকে বলছিলেন তিনি।

সরোয়ার বলেন, আমার মতো অনেকেই অসুস্থ হচ্ছেন। তবে পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে সরবরাহকৃত স্যালাইন, পানি, ফ্রুট ড্রিংস এবং গ্লুকোজ পাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি মিলেছে। তার মতে, এখনও তার জোনে কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েনি। কিন্তু বেশির ভাগ ট্রাফিক সদস্য দায়িত্ব পালনকালে মাথা ঘোরা অনুভব করছেন। পরে তারা দ্রুত সেখানে আরেকজনকে রেখে ছায়ায় গিয়ে বসতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু ডিউটি তারা নিয়মিত যথাসময় ধরেই করে যাচ্ছেন।

গুলশানের ট্রাফিক বিভাগের এডিসি হাফিজুর রহমান রিয়েল ঢাকা মেইলকে বলছিলেন, আমাদের তো ডিউটি ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সবাই রোদ ছেড়ে কোনো ভবনের নিচে বা ছায়ায় আশ্রয় নিতে পারেন, কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা তা পারেন না। তারা এই কড়া রোদের মাঝেই দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করে যাচ্ছেন। কারণ তারা একটু এপাশ-ওপাশ হলেই পুরো রাস্তায় যানজট লেগে যাবে। ফলে আমরা এই তীব্র তাপমাত্রার মধ্যেও দায়িত্বটা পালন করছি।

তিনি জানান, ট্রাফিক পুলিশের প্রতিটি সদস্যকে উৎসাহ দিতে ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে পানি, স্যালাইন, ফলমুলের ড্রিংস ও গ্লুকোজ সরবরাহ হচ্ছে। এছাড়াও আগে থেকেই তাদের ছাতা দেওয়া হয়েছে। নতুন এই আইটেমগুলো শুধুমাত্র তাদের স্বস্তি দিতেই যোগ করা হয়েছে। এরপরও অনেকে নিজ খরচেও গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অনেক কিছু খাচ্ছেন।

গুলশানের এই দুই কর্মকর্তার সাথে যখন কথা হচ্ছিল তখন ঘড়ির কাটায় সাড়ে তিনটা। আর রোদের পারদ উঠেছে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এর মাঝেও বনানীর কাকলী মোড় ও প্রগতি স্মরণী রোডের কুড়াতলী মোড়ে দায়িত্ব পালন করছেন ট্রাফিক সদস্যরা, জানাচ্ছিলেন হাফিজুর রহমান।

গরমের মাঝেও ঢাকার শাহবাগ, মোহাম্মদপুর বেঁড়িবাধ, ধানমন্ডি-৩২ এর বাংলাদেশ আই হাসপাতালের সামনের মোড়, সংসদ ভবনের সামনে, মতিঝিল এলাকা, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, লালবাগ, হাজারীবাগ, মিরপুরের বিভিন্ন সড়ক এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় ট্রাফিক সদস্যরা অন ডিউটি করে যাচ্ছেন। তবে সকাল থেকে ১০টা পযন্ত তেমন বেগ পেতে না হলেও দুপুর ১২টার পর থেকে কয়েকদিন থেকে তাপ বাড়ায় কষ্টটা বেড়েছে ট্রাফিক সদস্যদের। বিশেষ করে আজ তাদের অনেকের অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে।

মোহাম্মদপুর ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্ট লিমা চিশিম ঢাকা মেইলকে বলেন, দায়িত্ব পালনকালেই বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। যদিও আমরা ডিউটিতে অনেক বেশি পানি খাই। কিন্তু বাসায় ফিরে জ্বরজ্বর লাগছে। ফলে আসামাত্রই তো গোসলও করা যাচ্ছে না। সময় নিয়ে সেটি করতে হচ্ছে। কড়া রোদে যখন দাঁড়িয়ে ডিউটি করি তখন মনে হচ্ছে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। এমনকি ডিউটি পালনকালে তিনি মাথা ঘোরা, মাথা ব্যাথার মতো অনুভবও করছেন।

trafic_5
গুলশান এলাকার সার্জেন্ট মোস্তাক আহমেদ ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরাও তো মানুষ। আমাদেরও গরম লাগে। গরমে শরীর পুড়ে যায়। দায়িত্ব পালন শেষে পুরো শরীর জুড়েই নেমে আসে ক্লান্তি। যা শরীরকে অবশ করে দিচ্ছে। ফলে তারা সেই সময় প্রচুর পানি পান করে সেই ক্লান্তি মেটাচ্ছেন বলে জানান এই সার্জেন্ট।

কড়া রোদের মাঝে ডিউটি করলে বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা ডিএমপির পক্ষ থেকে সরবরাহকৃত জুস খাচ্ছেন বলে জানালেন বনানী এলাকায় সোমবার দুপুর থেকে দায়িত্বপালনকারী ট্রাফিক সদস্য সালাউদ্দিন।

বনানী এলাকার কাকলী মোড়ে বিকেল তিনটার দিকে দেখা গেলো, ট্রাফিকের এক সদস্য হাতে ছাতা ধরে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন আর নির্দেশনা দিচ্ছেন গাড়ির চালকদের। অথচ তখনও রাজপথে রোদের তাপ ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে।

বিভিন্ন এলাকায় দায়িত্বপালনকারী ট্রাফিক সদস্যরা জানিয়েছেন, রাজধানীর যেসব সড়কে তারা দায়িত্ব পালন করছেন সেগুলোর বেশির ভাগই পিচঠালা পথ। ফলে এই পিচের রাস্তা গরমে হয়ে কড়া রোদের ঝাঁজ উঠছে। এছাড়াও রোদের সাথে আছে গরম বাতাস। যা শরীরে এসে বিধে যাচ্ছে। এতে চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যাদের রোদো এ্যালার্জি রয়েছে তারা বেশি ভুগছেন। পুরো শরীর লাল হয়ে ঘামাচিতে ছেয়ে যাচ্ছে। জ্বালাপোড়া শুরু হচ্ছে। এসবকে সহ্য করেও তারা প্রতিদিন নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

তারা আরও জানিয়েছেন, ট্রাফিক সদস্যরা হিটস্ট্রোকসহ পানিশূন্যতা, মাথা ব্যথা ও শারীরিক দুর্বলতায় ভুগছেন। কেউ কেউ ডিহাইড্রেশনজনিত সমস্যায় ভুগছেন। বিশেষ করে যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের গরমে দায়িত্ব পালন করতে আরও বেশি সমস্যা হচ্ছে।

ট্রাফিকের উত্তরা বিভাগের এসি (পশ্চিম) ফেরদৌস হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদের কোনো সদস্য এখনও অসুস্থ হয়নি। তবে এই অবস্থায় তাদের ডিউটি করতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। এই কষ্ট লাঘবে ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে পানি, ছাতা, জুস, স্যালাইন ও গ্লুকোজ দিয়েছি আমরা।

ট্রাফিকের কন্সটেবলরা বলছেন, কড়া রোদে রাস্তায় থাকতে হবে, তারা বিষয়টিকে মানিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন।

ট্রাফিক কনস্টেবল তহিদুল ইসলাম, রফিক ও এম সালাম জানান, রোদের তাপে রাস্তার পিচও গলে যাচ্ছে। একদিকে রোদের তাপ। গাড়ির ধোঁয়া। রাস্তা দিয়ে যেনো আগুনের তাপ উঠছে। এর মাঝে আছে যানবাহনের হর্ন ও হুটারের (ইলেকট্রিক হর্ন) শব্দ। এসব যন্ত্রণাকে মেনে নিয়েই তারা তাদের কাজ করে যাচ্ছেন। তবে খুশির সংবাদ এ বিষয়গুলো তাদের কর্মকর্তারা দেখছেন ও সেই অনুযায়ী কি কি করণীয় তা তারা নির্দেশনা দিচ্ছেন। পাশাপাশি তাদের স্বস্তি দিতে পানি, স্যালাইন, জুস, শরবত, ছাতাসহ বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ করেছেন।

ডিএমপি সূত্র জানায়, এখন ঢাকা মহানগরীতে ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত আছেন ৩ হাজার ৮৭৬ জন। এর মধ্যে অতিরিক্ত কমিশনার থেকে কনস্টেবলও রয়েছে। তাদের মধ্যে সরাসরি মাঠে কাজ করেন ৩ হাজার ৫০০ সদস্য। তারা তিন শিফটে নগরীতে ট্রাফিক সেবা দিয়ে থাকেন। সেই রোস্টার এখনও পরিবর্তন হয়নি। নিয়মিত চলছে। প্রথম শিফট সকাল সাড়ে ৬টা থেকে দুপুর আড়াইটা। দ্বিতীয় শিফট দুপুর আড়াইটা থেকে রাত ১১টা। রাতের শিফট ১১টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত চলছে।

ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক প্রধান) মুনিবুর রহমান জানান, ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের মনোবল বাড়াতে আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে একদিকে ফোর্সের মনোবল যেমন চাঙ্গা হচ্ছে অপরদিকে তাপপ্রবাহের মধ্যেও ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে নগরবাসী পাচ্ছেন সর্বোত্তম সেবা।

Check Also

বাংলাদেশ থেকে আম নিতে চায় চীন!

বাংলাদেশ থেকে এ বছরই চীন আম নিতে চেয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *